এম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ১৮ জুন ॥
যৌতুকের জন্য বারবার নির্যাতন ও বহু বিবাহের জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় স্ত্রী ও শ্বাশুর-শ্বাশুড়ীকে ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে সেলিম উল্লাহ আজাদ নামের এক মাদক ব্যবসায়ী। গত ২৮ মে স্ত্রী ছামিরা আক্তার, তার বৃদ্ধ ও অসুস্থ পিতা-মাতা এবং তাদের সাথে থাকা ৪ মাসের দুগ্ধপোষ্য এক শিশু সন্তানকে বহনকারী সিএনজি গাড়ীতে কৌশলে ইয়াবা ডুকিয়ে দেয় এবং রেজু খালস্থ যৌথ চেক পোষ্টে নিজেই উপস্থিত থেকে বিজিবি’র কাছে ধরিয়ে দেয় এই মাদক ব্যবসায়ী। বিজিবি বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রামু থানায় দায়েরকৃত মামলায় ও মামলার জব্দ তালিকার ১নং স্বাক্ষীও হয় সেলিম উল্লাহ আজাদ। ঘটনার শিকার স্ত্রী ছামিরা আক্তার(২২), শ্বাশুর সদ্য বিদেশ ফেরত আব্দুর রহিম প্রকাশ সোনা মিয়া (৫৬) ও শ্বাশুড়ি হামিদা বেগম (৪৫) টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কচুবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা। ৪ মাসের দুগ্ধ পোষ্য শিশু সহ তারা বর্তমানে জেলাকারাগারে রয়েছে।
অমানবিক ও ন্যাক্কার জনক এই ঘটনা নিয়ে পুরো কক্সবাজার জেলা জূড়ে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ ঘটনায় ভূক্তভোগীর পরিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার পুলিশ সুপার, ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক, জেলা আইনগত সহায়তা সংস্থা ও মানবাধিকার কমিশন সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করেছে।
সুত্রে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের চিহ্নিত অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ী উত্তর বাহারছড়ার জনৈক নূরুল হকের ছেলে সেলিম উল্লাহ আজাদ (৩২) পূর্বে একাধিক বিয়ের কথা গোপন রেখে গত ২০১৪ সালের ৬ জুন রেজি:যুক্ত ৫১৩ নং কামিননামা মূলে টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কচুবনিয়া গ্রামের আবদুর রহিম প্রকাশ সোনা মিয়ার কন্যা ছমিরা আক্তার (২২) কে বিয়ে করে ঘরে তোলে। ইতিমধ্যে মাদক ব্যবসায়ী সেলিম আজাদ ও ছামিরা আক্তারের সংসারে সিয়াম নামের একটি পূত্র সন্তানেরও জন্ম হয়। বিয়ের কিছু দিন যেতে না যেতেই মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদ যৌতুক সহ বিভিন্ন অনৈতিক দাবীতে স্ত্রী ছামিরা আক্তার কে নির্মম নির্যাতন শুরু করে। ইতিমধ্যে ছামিরার দিনমজুর পিতা কর্মসংস্থানের আশায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দালালের খপ্পরে পড়ে সমূদ্র পথে মালয়েশিয়ায় গিয়ে আটক পরবর্তী কারাবন্দি হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। সম্প্রতি তিনি অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেন।
সুত্রে আরো জানা যায়, মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদ তার স্ত্রী ছামিরা আক্তার কে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় বেশ কয়েকবার স্থানীয় ভাবে ও কক্সবাজার সদর মড়েল থানায় শালিস-বিচারও হয় । এছাড়া সেলিম উল্লাহ আজাদের নির্মম মারধরে গুরুতর আহতাবস্থায় স্ত্রী ছামিরাকে একাধিকবার কক্সবাজার সদর মড়েল থানার পুলিশ উদ্ধার করে ছামিরার মা-ভাইকে দেন। তারা চিকিৎসা করে ছামিরার সুখের আশায় ধার-দেনা করে ২০/৩০ হাজার টাকা যোগার করে যৌতুক দিয়ে আবার সেলিম উল্লাহ আজাদের সংসারে পাঠায়। সর্বশেষে গত ৬ মে যৌতুকের দাবীতে স্ত্রী ছামিরা আক্তার কে বেদম মারধর করে শিশু সন্তান সহ পিত্রালয়ে তাড়িয়ে দেয় সেলিম আজাদ। এর মধ্যে গত ২২ মে ছামিরার পিতা আব্দুর রহিম প্রকাশ সোনা মিয়াও পঙ্গু অবস্থায় শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসেন।
গত ২৮ মে বিকালে ছমিরার অসুস্থ পিতা ও ভাইয়ের ৪ মাসের শিশু পূত্রকে চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারে আসার পথে মাদক ব্যবসায়ী স্বামী সেলিম উল্লাহ আজাদ জোর করে কেড়ে নেওবার ভয়ে নিজের ১০ মাসের বাচ্চাটি ভাবীর কাছে রেখে নিজ গ্রামের আবু নায়েছ নামের এক ড্রাইভারের সিএনজি গাড়ীতে করে কক্সবাজার আসছিল। তাদের বহনকারী সিএনজি গাড়ীটি রামু থানাধীন মেরিন ড্রাইভ হয়ে রেজুখালস্থ যৌথ চেকপোস্টে পৌছলে কর্তব্যরত ১৭ বিজিবির সদস্যরা সিএনজি গাড়ীটি তল্লাশী শুরু করে। এসময় সেখানে পূর্ব থেকেই দাঁড়িয়ে থাকে মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদ এবং দ্রুত পালিয়ে যায় সিএনজির চালক আবু নাছের। বিজিবির সদস্যরা সিএনজি গাড়ীটি তল্লাশীর এক পর্যায়ে ১৭৫০পিচ ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়ার অভিযোগে ছামিরা আক্তার(২২), আব্দুর রহিম প্রকাশ সোনা মিয়া (৫৬) ও হামিদা বেগম (৪৫) কে আটক করে। উদ্ধারকৃত ইয়াবার জব্দ তালিকা তৈরী করে ও তাতে ১নং স্বাক্ষী হিসেবে মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদেরই স্বাক্ষর নিয়ে আটককৃতরা ও ৪ মাসের শিশুটিসহ রামূ থানায় সোপর্দ করে ১৭ বিজিবির হাবিলদার মোঃ শরীফ উল্লাহ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে (নং-৪০,তাং-২৮/০৫/২০১৬, জি.আর-১৬৩/২০১৬) মামলা দায়ের করেন। উল্লেখিত ঘটনায় প্রশ্ন ওঠেছে,ঘটনার দিন ও সময়ে নিজের স্ত্রী ও শ্বাশুর-শাশুড়ি যে ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে কক্সবাজারে আসছে- তা মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদ জানলো কি ভাবে ? সে ঘটনাস্থলে-ঘটনার সময়ে কেন গিয়েছিল আর কর্তব্যরত বিজিবির সদস্যরা যেখানে অজ্ঞাতনামা পলাতক হিসেবে সিএনজি চালককে আসামী করলো। অথচ আটককৃতদের একজনের স্বামী ও অপর দুইজনের জামাতা এবং ঘটনাস্থলের উপস্থিত চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদকে আসামী করার বদলে মামলায় ও জব্দ তালিকার ১নং স্বাক্ষী কেন করা হল ?। এনিয়ে যতেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
মামলার বাদী ১৭ বিজিবির হাবিলদার মোঃ শরীফ উল্লাহ’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় সেলিম উল্লাহ আজাদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বলে তাকে স্বাক্ষী করা হয়েছে। সেলিম উল্লাহ আজাদ যে মাদক ব্যবসায়ী বা আটককৃতদের আত্মীয় তা জানা ছিল না’। আটককৃতরা প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ী বা ঘটনায় আদৌ জড়িত কিনা? নাকি তাদের কোন অপকৌশলে ফাঁসানো হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিবির হাবিলদার মোঃ শরীফ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা যাদের দখলে এসব মাদকদ্রব্য পেয়েছি, তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছি। বাকীটা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত স্বাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন’।
ঘটনার শিকার কারাবন্দি ছামিরার দিন মজুর ভাই নুরুল হক জানান, তার ছোট বোনের স্বামী মাদক ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ আজাদ কৌশলে ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে তার নির্যাতিত বোন ও বৃদ্ধ অসুস্থ মা-বাবাকে ফাঁসানোর অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার পুলিশ সুপার, ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক, জেলা আইনগত সহায়তা সংস্থা ও মানবাধিকার কমিশন সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করেছি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রামু থানার উপ-পরির্দশক (এসআই) সঞ্জয় কুমার বলেন, নিজের স্ত্রী ও শ্বাশুর-শাশুড়ী কক্সবাজার আসা কালে চেকপোষ্টে আগে থেকেই সেলিম উল্লাহ আজাদের উপস্থিতি ও তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় স্বাক্ষী হওয়া রহস্যের সৃষ্টি করে। ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছি, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিবিড় ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে’।
রামু থানার অফিসার ইনচার্জ প্রভাষ চন্দ্র ধর জানান, ঘটনাটি শুনেছি, তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠকের মতামত: